সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৩

ছোট গল্প


রহস্য

রহস্য জাতীয় ব্যাপারগুলিতে আমার তেমন বিশ্বাস নেইতবু প্রায়ই এ রকম কিছু গল্প-টল্প শুনতে হয়গত মাসে ঝিকাতলার এক ভদ্রলোক আমাকে এসে বললেন, তার ঘরে একটি তক্ষক আছে সেটি রোজ রাত ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকেআমি বহু কষ্টে হাসি থামালামএ রকম সময়নিষ্ঠ তক্ষক আছে নাকি এ যুগে? ভদ্রলোক আমার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বললেন, কি ভাই বিশ্বাস করলেন না?
জ্বি না
এক রাত থাকেন আমার বাসায়নিজের চোখে দেখেন তক্ষকটাঘড়ি ধরে বসে থাকবেনদেখবেন ঠিক ১টা ২৫ মিনিটে তিনবার ডাকবে
আরে দুর! কি যে বলেন?
ভদ্রলোক মুখ কালো করে উঠে গেলেনচারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা পৃথিবীটা এরকম, যার সঙ্গে দেখা হবার তার সঙ্গে দেখা হয় নাভুল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়আমাকে দেখেই ভদ্রলোক গম্ভীর মুখে বললেন, আপনি কি দৈনিক বাংলার সালেহ সাহেবকে চেনেন?
হ্যাঁ চিনি
তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলামতিনি নিজের কানে শুনেছেনবলেছেন একটা নিউজ করবেন
ভালই তোনিউজ হবার মতই খবর
আপনি আসেন না ভাই, থাকেন এক রাত
আমাকে শোনালে কি হবে?
আরে ভাই আপনারা ইউনিভার্সিটির টিচারআপনাদের কথার একটা আলাদা দাম
তাই নাকি?
আপনারা একটা কথা বললে কেউ ফেলবে না
এই জিনিসটা নিয়ে খুব হৈ-চৈ করছেন মনে হচ্ছে?
না, হৈ-চৈ কোথায়? অনেকেই অবশ্যি শুনে গেছেনবাংলাদেশ টিভির ক্যামেরাম্যান নাজমুল হুদাকে চেনেন?
জ্বি না
উনিও এসেছিলেনখুব মাইডিয়ার লোকআপনি আসুন না
আচ্ছা ঠিক আছে, একদিন যাওয়া যাবে
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলতিনি মুখভর্তি করে হাসলেনটেনে-টেনে বললেন, চলেন চা খাই
না, চা খাব না
আরে ভাই আসেন নাপ্রফেসর মানুষ, আপনাদের সঙ্গে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার
ভদ্রলোক হা হা করে হাসতে লাগলেনযেতে হল চায়ের দোকানে
চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবেন? চপ?
না
আরে ভাই খান নাএই এদিকে দুটো চা দে তোএখন ভাই বলেন, কবে যাবেন?
আপনার সঙ্গে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলে দেব একদিন
চা খেতে খেতে ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটা রহস্যের কথা শুরু করলেননাইনটিন সিক্সটিতে তিনি বরিশালের পিরোজপুরে থাকতেনতার বাসার কাছে বড় একটা কাঁঠাল গাছ ছিলঅমাবস্যার রাতে নাকি সেই কাঁঠাল গাছ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, সেই কান্নারও কি কোন টাইম ছিল? নির্দিষ্ট সময়ে কাঁদত? আপনার তক্ষকের মত?
ভদ্রলোক আহত স্বরে বললেন, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
বিশ্বাস করব না কেন?
আমি কান্নার শব্দ গোটাটা টেপ করে রেখেছিএকদিন শোনাব আপনাকে
ঠিক আছে
বরিশালের ডিসি সাহেবও শুনেছেনচেনেন উনাকে? আসগর সাহেবসি এস পিখুব খান্দানী ফ্যামিলি
না, চিনি না
ডিসি সাহেবের এক ভাই আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকেবিরাট অফিসার
তাই বুঝি?
জ্বিউনার বাসায় একদিন গিয়েছিলামখুব খাতির-যত্ন করলেনগুলশানের বাসাতিন তলাউনি থাকেন এক তলায়ওপরের দুটো তলা ভাড়া দিয়েছেন
ভদ্রলোক আমার প্রায় এক ঘন্টা সময় নষ্ট করে বিদায় হলেনআমার মায়াই লাগলো ইন্ডেন্টিং ফার্মে সামান্য একটা চাকরি করেনদেখেই বুঝা যায় অভাবে পর্যুদস্তচোখের দুষ্টি ভরসাহারাবয়স এখনো হয়তো ত্রিশ হয়নি কিন্তু বুড়োটে দেখায়বিচিত্র চরিত্র
মাস খানেক তার সঙ্গে আমার দেখা হল নাতার প্রধান কারণ, যে সব জায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা সে সব জায়গা আমি এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিনিউমার্কেটে আড্ডার জায়গাটিতে যাই নাকি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে? এই লোকটি পিচ্ছিল পদার্থ, সে গায়ের সঙ্গে সেঁটে যাবেআর ছাড়ানো যাবে না কিন্তু তবু দেখা হলএকদিন শুনলাম সে ইউনিভার্সিটি ক্লাবে এসে খোঁজ নিচ্ছে ক্লাবের বেয়ারা বলল, গত কিছুদিন ধরে নাকি সে নিয়মিতই আসছেকি মুসিবত
একদিন আর এড়ানো গেল নাভদ্রলোক বাসায় এসে হাজির
কি ভাই আপনি তো আর এলেন না?
কাজের ব্যস্ততা
আজকে আপনাকে নিতে এসেছি
সে কি?
কবি শামসুল আলম সাহেবও আসবেন
তাই বুঝি?
জ্বিচিনেত তো শামসুল আলম সাহেব কে? দুটো কবিতার বই বেরিয়েছেপাখির পালক আর অন্ধকার জ্যোত্স্না
তাই বুঝি?
জ্বিআমাকে দুটো বই-ই দিয়েছেনখুবই বন্ধু মানুষবাড়ি হচ্ছে আপনার ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা

উনার ছোট ভাইও গল্প টল্প লেখেনআরিফুল আলম
গেলাম তার বাসায়ঝিকাতলার এক গলিতে ঘুপসি মত দুকামরার বাড়িমেজাজ খুবই খারাপরাত দেড়টা পর্যন্ত বসে থাকতে হবে সময়নিষ্ঠ তক্ষকের ডাক শোনার জন্যকত রকম যন্ত্রণা যে আছে পৃথিবীতে!
ভদ্রলোক আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে অতি ব্যস্ততার সঙ্গে ভেতরে চলে গেলেন বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানোমহিলার হাতের সযত্ন স্পর্শ আছেভদ্রলোক বিবাহিত জানতাম নাএ নিয়ে তার সঙ্গে কখনো কথা হয়নিকিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেনখুবই অল্প বয়েসী তরুণী এবং অসম্ভব রূপসীআমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম
আমার স্ত্রী লীনাআর লীনা, উনি হুমায়ূন আহমেদএর কথা তো তোমাকে বলেছি
লীনা হাসি মুখে বললো, জ্বি আপনার কথা প্রায়ই বলে
লীনা একটু চায়ের ব্যবস্থা কর
লীনা চলে গেল ভেতরেভদ্রলোক নিচু গলায় বললেন, লীনার গল্প-উপন্যাস লেখার শখ আছেকয়েক দিন আগে সাপ নিয়ে একটা গল্প লিখেছেমারাত্মক গল্প ভাই আপনাকে পড়ে শোনাতে বলবোআমি বললে পড়বে নাআপনিও কাইন্ডলি একটু বলবেন
আমি বললাম, গুণী মহিলাতো!
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো
তা ভাই, কথাটা অস্বীকার করব নাগানও জানেনজরুল গীতিভালো গায়বাড়িতে টিচার রেখে শিখেছে
তাই নাকি?
জ্বি, শোনাবে আপনাকেএকটু প্রেসার দিতে হবে আর কিআপনি একটু রিকোয়েস্ট করলেই শোনাবেকাইন্ডলি একটু রিকোয়েস্ট করবেন
ঠিক আছে, করব
চা এসে পড়লচায়ের সঙ্গে বড়া জাতীয় জিনিসবেশ খেতেআমি বললাম, কিসের বড়া এগুলি? ডালের নাকি?
ভদ্রলোক উচ্চস্বরে হাসলেন, নারে ভাই, কুলের বড়াহা-হা-হাকত রকম অদ্ভুত রান্না যে জানে! মাঝে মাঝে এত সারপ্রাইজ হইখেতে কেমন হয়েছে বলেন? চমত্কার না?
ভাল, বেশ ভাল
আরেক দিন আসবেন, চাইনীজ সুপ খাওয়াবোচিকেন কর্ন সুপচাইনীজ রেস্তোরাঁর চেয়ে যদি ভালো না হয় তাহলে কান কেটে ফেলবেনহা-হা-হা
আমি মেয়েটার লেখা একটা ছোট গল্প শুনলাম, দুটি কবিতা শুনলামভদ্রলোক মুগ্ধ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেনবার বার বললেন, ইস শামসুল আলম সাহেব আসলেন না দারুণ মিস্ করলেন, কি বলেন ভাই?
রাত এগারোটার দিকে বললাম, তা হলে আজ উঠি?
তক্ষকের ডাক শুনবেন না?
আরেক দিন শুনব
আচ্ছা, ঠিক আছেভুলবেন না যেন ভাইআসতেই হবে
ভদ্রলোক আমাকে এগিয়ে দিতে এলেনরাস্তায় নেমেই বললেন, আমার স্ত্রীকে কেমন দেখলেন ভাই?
ভাল, গুণী মহিলা
ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলধরা গলায় বললেন, বাঁদরের গলায় মুক্তার মালাঠিক না ভাই?
আমি কিছু বললাম নাভদ্রলোক কাঁপা গলায় বললেন, গরীব মানুষ, স্ত্রীর জন্যে কিছুই করতে পারি নাকিন্তু এই সব নিয়ে লীনা মোটেই মাথা ঘামায় নাবড় ফ্যামিলির মেয়ে তোওদের চাল চলনই অন্য রকম
আমি রিকশায় উঠতে উঠতে বললাম, খুব ভাগ্যবান আপনি
ভদ্রলোক আমার হাত চেপে ধরলেনযেন আবেগে কেঁদে ফেলবেন
ভাই, আরেকদিন কিন্তু আসতে হবেতক্ষকের ডাক শুনতে হবেআসবেন তো? প্লীজ
তক্ষকের ডাকের মত কত রহস্যময় ব্যাপারই না আছে পৃথিবীতে!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন